বেবি চক্রবর্ত্তী, ভারত প্রতিনিধি:– ছোটবেলা থেকেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী | ১৯২১ সাল | সুভাষচন্দ্র বসু আইসিএস পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছিলেন | কিন্তু তিনি ঠিক করেন আইসিএস ছেড়ে দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে কাজ করবেন | সুভাষচন্দ্র বসুর বাবা জানকীনাথ বসু প্রথমে এই সিদ্ধান্তে পুরোপুরি সম্মতি দেননি | সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী দেবীকে এই কথা জানান এবং দেশের কাজ করার অনুমতি চান | জবাবে প্রভাবতী দেবী সুভাষচন্দ্র বসুকে বলেন “আমি ত্যাগের মন্ত্রে বিশ্বাস করি।” এই কথা শোনার পর আর পিছনে তাকাননি নেতাজিকে | ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে |

বসু পরিবারের বাস ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে । রেলস্টেশন চিংড়ি পোতা যেটি বর্তমানে (সুভাষ গ্রাম)নামে পরিচিত। কিছুদূর পদব্রজে গেলেই হরনাথ বসুর বাড়ি। তিনি দুবার বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রীর একমাত্র পুত্র ছিলেন দেবনাথ বসু। তিনি ছিলেন অতি বিদ্বান কটকের রাভেনশ কলেজে অধ্যাপনা করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর তিন পুত্র ও এক কন্যা। জানকীনাথ বসু পুত্রদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।ত্রয়ী শিক্ষিত উপযুক্ত ছিলেন। কোদালিয়া গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা-যাওয়া করে পড়াশোনা করতেন। সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ছিল না। সেজন্য জানকীনাথ বসু কে শিক্ষালাভের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে হয়েছে। তিনি কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং সব পরীক্ষায় স্কলারশিপ পেয়েছেন। এই সামান্য অর্থ না পেলে তার লেখাপড়ার কি করে চলত জানিনা। বই কিনবার তার ক্ষমতা ছিল না। কলেজে সহপাঠীদের কাছ থেকে বই নিয়ে তিনি হাতে লিখে নকল করে নিতেন।সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়াশোনা করার মতো তেলটুকু ছিল না, এছাড়াও সংসারের কাজকর্ম তাকেই করতে হতো এইভাবে লেখাপড়া করে তিনি আইন পরীক্ষায় পাশ করেন।

সুভাষচন্দ্র অসাধারণ কিন্তু তার পিতা জানকীনাথ এর জীবন কাহিনী অনেকেই জানেন না। তিনিও কম অসাধারণ ছিলেন না। এমন পিতারই শরৎচন্দ্র ও সুভাষ চন্দ্রের মতো পুত্র হওয়া স্বাভাবিক।

জানকীনাথ এর বিবাহ একটি চমকপ্রদ ঘটনা। তার সুযোগ্য পত্নী প্রভাবতীর পিতামহ ছিলেন গঙ্গানারায়ণ দত্ত। তার পিতার নাম কাশীনাথ দত্ত। তাদের পরিবার বিখ্যাত হাটখোলার দত্তের একটি শাখা। এই শাখা কলিকাতার অদূরে বরাহনগরে বাস করতেন। গঙ্গানারায়ণ দত্ত তাঁর প্রথমা পৌত্রী প্রভাবতীর বরের অন্বেষণে কলেজে গিয়ে হাজির। দেখলেন একটি কালো রোগা ছাত্র এক জায়গায় বসে কি লিখছে,তখন টিফিনের ছুটি। অন্যেরা খেলাধুলো গল্পগুজবের ব্যস্ত।তিনি সেই ছেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সে কেন অন্যদের মত খেলছে না ? জানকীনাথ বললেন তার বই কেনার সামর্থ্য নেই তাই বন্ধুদের থেকে বই নিয়ে লিখে নিচ্ছেন। গঙ্গানারায়ণ তার পিতার নাম ঠিকানা ইত্যাদি জেনে নেন এবং জানকীনাথ বসুর সঙ্গেই তার অপরুপা সুন্দরী পৌত্রী প্রভাবতীর বিবাহ স্থির করে ফেললেন।

বিবাহের পর প্রভাবতীর পিতা কাশীনাথ দত্ত যখন মেয়েকে দেখতে তার শ্বশুরবাড়ি গেলেন তাদের পারিবারিক অবস্থা দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। ফিরে পিতাকে বলেন “বাবামশাই আপনি আমার সোনার প্রতিমার মত মেয়েকে জলে ফেলে দিলেন ?”

পিতা উত্তর দিলেন “জলে ফেলেছি কি কিসে ফেলেছি সময় এলে দেখো” । জানকীনাথ ওকালতি করবেন কিন্তু কলকাতায় তার বাসস্থান, জানা পরিচয় কিছুই নেই । পিসেমশাই হরবল্লব বসু কটক এর প্রতিষ্ঠিত খ্যাতিসম্পন্ন উকিল ছিলেন। তিনি জানকীনাথ বসু কে কটকে গিয়ে ওকালতি শুরু করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জানকীনাথ এই সুযোগ গ্রহণ করে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ইংরেজ সরকার তাকে “রায়বাহাদুর” উপাধি দেন এবং Govt plider নিযুক্ত হন। স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রায়বাহাদুর উপাধি পরিত্যাগ করেন।

সেই সময়ে স্টিমার পার হয়ে কটক পৌঁছতে হতো তারপর গরুর গাড়িতে গন্তব্য স্থল। এমন গল্প আমরা মা জননীর কাছে শুনেছি।

প্রভাবতী দেবীর জন্ম ১৮৬৯ সালে উত্তর কলকাতার বরানগরের দত্ত পরিবারে | বাবা গঙ্গানারায়ণ দত্ত, মা কমলা কামিনী দেবী | আট ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে প্রভাবতী দেবী ছিলেন সবচেয়ে বড় | ১৮৮০ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রভাবতী দেবীর বিয়ে হয় সোনারপুরের কাছে কোদালিয়ার বিখ্যাত বসু পরিবারের ২০ বছরের জানকীনাথ বসুর সাথে |

জানকীনাথ বসু ছিলেন কটকের বড় উকিল তাই তিনি সংসারের জন্যে খুব বেশী সময় দিতে পারতেন না | কটকে থাকাকালীন প্রভাবতী দেবী একা হাতে সামলাতেন গোটা সংসার | প্রভাবতী দেবীর পাঁচ ভাইও তার কাছে থেকে পড়াশোনা করতেন | প্রভাবতী দেবীর দুই বোন খুব অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যান তাই তারাও থাকতেন প্রভাবতী দেবীর সঙ্গে | এর পাশাপাশি বাড়ির বিভিন্ন কাজের লোকদেরকেও একাই সামলাতেন | সময় পেলে অবশ্য জানকীনাথ বসু এবং প্রভাবতী দেবী গাড়ি করে সন্ধ্যাবেলা কটকে নদীর ধারে ঘুরতে যেতেন |

প্রভাবতী দেবী ছিলেন অত্যন্ত উদার এবং সম্পূর্ণ কুসংস্কারমুক্ত | জাতপাত এবং ধর্মীয় ভেদাভেদে তিনি একেবারেই বিশ্বাস করতেন না | সেই শিক্ষাই তিনি নিজের ভাইবোন এবং ছেলেমেয়েদের দিয়েছিলেন | সকল ছেলেমেয়ে , ভাইবোনদের ‘কথামৃত’ পড়ে শোনাতেন তিনি | ভাইবোন,ছেলেমেয়েরা ঠিকমত পড়াশোনা করছে কিনা তাই নিয়েও প্রভাবতী দেবীর ছিল সজাগ দৃষ্টি | কেউ পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে ধরে ফেলতেন |

খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে নিজে বেশিদূর পড়তে পারেননি প্রভাবতী দেবী | তাই বাড়িতে শিক্ষক রেখে নিজে পড়াশোনা করতেন | এমনকি ইংরেজি ভাষাতেও বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি | প্রভাবতী দেবীর হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মত | তার হাতের লেখা দেখেই বাড়ির ছোটরা হাতের লেখা অভ্যাস করত | এমনকি সেলাইয়ের কাজেও অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন প্রভাবতী দেবী | তার হাতের তৈরী চন্দ্রপুলি বসু বাড়িতে খুব বিখ্যাত ছিল | কেনাকাটার ব্যাপারেও তীক্ষ্ণ নজর ছিল প্রভাবতীদেবীর | এলগিন রোডের বাড়িতে আম বিক্রি করতে আসত আমওয়ালারা | বসু বাড়িতে একবারে আম কেনা হত কয়েকশো | সেই আম কেনার সময় দাঁড়িয়ে থেকে সব আম দেখে নিতেন প্রভাবতী দেবী, একটি আমও খারাপ দিতে পারত না আমওয়ালারা | এমনকি দরদামেও প্রভাবতী দেবীর সঙ্গে পেরে উঠত না তারা |

১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারী দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে দেশ ছাড়লেন নেতাজি | ১৯৪৩ সালের শেষদিকে কলকাতায় প্রয়াণ ঘটে ‘সুভাষ জননী’ প্রভাবতী দেবীর |