মো:আবদুল লতিফ,লক্ষীপুর প্রতিনিধি:-
সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা ও বৃষ্টিপাতে লক্ষ্মীপুর জেলায় কৃষি খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে এক লাখ ৫৭ হাজার ২০৯ জন কৃষক ২২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। বেশি ক্ষতি হয়েছে আউশ ও আমনের বীজতলার। এ ছাড়াও ক্ষতির তালিকায় রোপা আমন, সবজি ক্ষেত, শসা, করলা, লাউ, টমেটো, পান, আখ, হলুদ, আদা এবং নানা জাতের ফলজ গাছও রয়েছে।
এদিকে এখনো কমছে না পানি, শেষ হয়ে যাচ্ছে চাষাবাদের সময়ও। চাষাবাদ করতে না পেরে চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় লক্ষাধিক কৃষকের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। পানিতে বীজতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল নষ্ট হয়ে তাদের অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুক্ষিন হতে হয়েছে। এতে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এখন কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
জানা গেছে, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে সদর উপজেলার লাহারকান্দি, ভবানীগঞ্জ, দিঘলী, মান্দারী, বাঙ্গাখাঁ, চন্দ্রগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা। প্রথম দিকে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে যায় ক্ষেত-খামার, গ্রামীণ রাস্তাসহ মানুষের বসতঘর। এরমধ্যে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগতি, কমলনগর ও রামগঞ্জে। এতে পানি দ্বিগুণ উচ্চতা ধারণ করে। ডুবে যায় মাঠ-ঘাট, রাস্তা, বসতঘর ও ফসলী জমিগুলো। মাস পার হলেও কমছে না পানি। কোথাও কোথাও ২ মাস ধরেই পানিতে ডুবে আছে বিস্তির্ণ জনপদ। এখন আর চাষাবাদের সময়ও নেই। বন্যা আর জলাবদ্ধতার পানিতে আবাদকৃত জমি ডুবে এক লাখ ৫৭ হাজার ২০৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে তাদের ২২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।তবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনায় আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।
জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুরে চলতি মৌসুমে ৩ হাজার ৬০৭ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বন্যা, জলাবদ্ধতা ও জোয়ারের পানিতে দুই হাজার ৫৩৬ দশমিক ৮০ হেক্টর জমির বীজতলা তলিয়ে পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে, যা মোট বীজতলার ৭০ ভাগের বেশি। এতে ৬৩ হাজার ৪২০ জন কৃষকের ২৯ কোটি ২৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া রোপা আমনের আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯৪ হেক্টর জমিতে। পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে ৭ হাজার ৬১০ দশমিক ৭০ হেক্টর জমির, যা আবাদকৃত মোট জমির ৫৩ ভাগ। এতে ৩১ হাজার ৭০৬ জন কৃষকের ৮৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২৪ হাজার ৪২৩ জন কৃষকের ৪ হাজার ৭০ দশমিক ৫০ হেক্টর জমির আউশ ধান নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। বোনা আমনে ৯ হাজার ৭২০ জন কৃষকের এক কোটি দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ১০ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমির শরৎকালীন শাকসবজি নষ্ট হয়েছে, যা আবাদকৃত জমির শতভাগ। এতে ২০ হাজার ৭৮০ জন কৃষকের ৫১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পান নষ্ট হয়েছে ১১২ দশমিক ২ হেক্টর জমির। এতে ১৬৬৩ জন কৃষকের ক্ষতি ১৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আদা নষ্ট হয়েছে ২৪০ জন কৃষকের ৮৩ দশমিক ৩৩ হেক্টর জমির। ক্ষতি হয়েছে ৭০ লাখ টাকার। ৩৯ হেক্টর জমিতে থাকা ৯৮ টন হলুদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ২০৪০ জন কৃষকের ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। ৭৪৪ জন কৃষকের ৯ দশমিক ৩ হেক্টর জমির আখ নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৯ লাখ টাকা। ২০৭৩ জন ফল চাষীর ৪১ দশমিক ৪৬ হেক্টর জমির ফল বাগান নষ্ট হয়েছে। এতে ২০৭ টন ফলের ক্ষতি হয়েছে। যারা বাজার মূল্য ২ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
কেরোয়া ইউনিয়নের মধ্য কেরোয়া গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, এবার জমিতে শসা, করলা ও মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করা হয়েছে। পানি সব নিয়ে গেছে। এখন মাচায় সবজি গাছের শুকনো লতাপাতা জড়িয়ে আছে। কিছুই নেই। একেকজন কৃষকের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রায় কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হতো এখানে। যদি খরা হয়, তখন আবার চারা রোপন করা হবে।
পশ্চিম সাগর্দি গ্রামের আবুল কালাম জানান, একে একে তিনবার ধানের চারা রোপন করেছি। তিনবারই সব পানিতে শেষ হয়ে গেছে। আমার মতো হাজার হাজার কৃষক রয়েছে। সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করে, তাহলে আমাদের উপকার হবে।
বামনী গ্রামের কৃষক মো. নুরুজ্জামান বলেন, প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে আমন ধানের চারা লাগিয়েছিলাম। পানিতে সব ভেসে গেছে। এখনো ক্ষেতে কোমড় পরিমাণ পানি। এ মৌসুমে আর চাষ করা সম্ভব নয়। আমাদের দিকে কেউই তাকায় না। ধনীরা কেবল ধনীই হচ্ছে আর আমরা নি:শেষ হয়ে যাচ্ছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেন, লক্ষ্মীপুর জেলায় বন্যায় কৃষিখাতে প্রায় ২২৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়েছে। সরকার প্রণোদনার প্যাকেজ দিচ্ছে। তা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে আসছি। ইতিমধ্যে ছয় হাজার কৃষকের মাঝে আমন ধানের বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। তাদের ব্যাংক হিসেবে এক হাজার টাকা করে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ৬৫ হাজার কৃষকের জন্য শীত কালীন সবজির প্রণোদনা চাহিদা পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলে কৃষকদের মাঝে তাও বিতরণ করা হবে। ফসলি ক্ষেতগুলোতে প্রচুর পানি জমে আছে। পানি শুকাতে আরও কিছু সময় লাগবে। এ ক্ষতির রেশ কাটতেও কৃষকদেরকে অনেকদিন সময় লাগবে।
তিনি আরও বলেন, আগাম রবি মৌসুমের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ আমরা বুঝে পেয়েছি। ১৩ হাজার ২০০ কৃষকের মাঝে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমূখী, মুগ, মশুর, খেশারী, চিনা বাদাম, সয়াবিন ও শীতকালীন পেয়াজ বীজ বিতরণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।