লক্ষ্মীপুর জেলার বিস্তৃর্ণ মাঠ জুড়ে সয়াবিন ক্ষেত মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে এর সবুজ পাতা, কৃষকেরা ব্যস্ত রয়েছেন ক্ষেত পরিচর্যায়। সম্প্রতি এই দৃশ্য দেখা গেল লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চর বংশী ইউনিয়নের চর কাছিয়া গ্রামে। ইউনিয়নটির প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক করেছেন সয়াবিনের আবাদ।
কেবল এ ইউনিয়ন নয়, লক্ষ্মীপুর জেলার অনেক এলাকায় প্রায় দুই যুগ ধরে করা হচ্ছে সয়াবিনের চাষ। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশই মিলছে লক্ষ্মীপুর থেকে। আগে আমন মৌসুম শেষে অনাবাদি পড়ে থাকত ফসলি জমি। এসব জমিতেই সয়াবিনের আবাদ করা হচ্ছে। কৃষকেরা জানান, আগামী মে মাসের দিকে ফলন পাওয়া যাবে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে এর চেয়ে আরও ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর বেশি জমিতে সয়াবিনের আবাদ করা হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরে জেলায় অন্তত ৮৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যার বাজারমূল্য ৩২০–৩৫০ কোটি টাকা। দেশের খ্যাতনামা ভোজ্যতেল ও পোলট্রি খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সয়াবিন সংগ্রহ করেন। জেলার কমলনগর, রামগতি, রায়পুর ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সয়াবিন আবাদ হয়।
রায়পুর উপজেলার চারটি ইউনিয়নে সয়াবিন চাষ হয়। বিশেষ করে মেঘনা নদীর জেগে ওঠা চরাঞ্চল চরইন্দুরিয়া, চরজালিয়া, চরঘাসিয়া, চরকাছিয়া ও কানিবগা এলাকায় কয়েক হাজার একর জমিতে সয়াবিনের চাষ হচ্ছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, হাজীপাড়সহ আটটি ইউনিয়নে চাষ হয় সয়াবিনের। রামগতি ও কমলনগর উপজেলায়ও অনেক এলাকায় সয়াবিনের আবাদ করা হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এ অঞ্চলের উর্বর মাটি সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী। এখানকার মাটি দোআঁশজাতীয়। এ মাটিতে একবার লাঙল চালালেই তা সয়াবিন চাষের উপযোগী হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে প্রতিবছর ফলন লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যায়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আবাদের উপযুক্ত সময়। শিমজাতীয় গাছ হওয়ায় সয়াবিনখেতে খুব একটা সার দিতে হয় না। খেতে নিড়ানি দিয়ে আগাছাও পরিষ্কার করা লাগে না। গাছ বড় হলে এক-দুবার কীটনাশক দিতে হয়। চারা গজানোর ১৩০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে আসে।
রায়পুরের চর কাছিয়ার কৃষক ফারুক গাজী চলতি বছর প্রায় দেড় একর জমিতে সয়াবিন চাষ করেছেন। গত বছর করেছিলেন এক একর জমিতে। তিনি জানান, ফসল ঘরে আনা পর্যন্ত তাঁর মোট খরচ হবে ২৫ হাজার টাকার মতো। উৎপাদন স্বাভাবিক হলে ৭০ মণ সয়াবিন পাওয়া যাবে। প্রতি মণ ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করলেও প্রায় ১ লাখ টাকা আয় হবে তাঁর।
কৃষকেরা জানান, সয়াবিন আবাদে খরচ কম। রোগ ও পোকার আক্রমণও কম হয়। চাষাবাদের পদ্ধতি সহজ। বিক্রি করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় ধানের চেয়েও বেশি। যে কারণে সয়াবিন চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে।
জমির মালিক ও বর্গাচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে চরাঞ্চলে অনেক জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অনাবাদি জমি পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পরিত্যক্ত জমিতেও সয়াবিন চাষে সাফল্য মিলছে।
রায়পুরের হায়দরগঞ্জ বাজারের চেহারা গত ২০-২২ বছরে অনেকটাই বদলে গেছে কেবল সয়াবিনের কারণে। ছোট বাজারটির ৪৫ থেকে ৫০টি আড়তে এখন পাইকারিভাবে সয়াবিন বিক্রি হয়।
বাজারের সয়াবিন ব্যবসায়ী সাইজুদ্দিন মোল্লা বলেন, দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের ৭০ শতাংশের বেচাকেনা হয় এই বাজারে। বাজারেই গড়ে উঠেছে সয়াবিনের ১০টি চাতাল। পার্শ্ববর্তী খাসের হাট ও মোল্লার হাট বাজারেও আছে সয়াবিনের ২০টি আড়ত। বিশেষ করে এপ্রিল ও মে মাসে ক্রেতাদের আনাগোনা বেড়ে যায় এসব বাজারে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, সয়াবিন তেলজাতীয় শস্য। গাছ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। গাছের কাণ্ডে ফুল হয়। ফুল থেকে শিমের মতো চড়াতে বীজ জন্মে, এই বীজগুলোকেই সয়াবিন বলা হয়। সয়াবিন ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস। এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। কচি ও শুকনা সয়াবিনবীজ সবজি ও ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। পরিণত সয়াবিনবীজ থেকে শিশুখাদ্য, সয়া দুধ, দই, পনির, বিস্কুট, কেকসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার তৈরি হয়ে থাকে। এ ছাড়া পোলট্রি ও ফিশ ফিড তৈরি, রং, সাবান, প্লাস্টিক মুদ্রণের কালি ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সয়াবিন একটি অপরিহার্য উপাদান।
লক্ষ্মীপুরে প্রতিবছরই সয়াবিনের আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানান লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মাটি সয়াবিন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এরই মধ্যে লক্ষ্মীপুর ‘সয়াল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৮০ শতাংশ চাষাবাদ হয় লক্ষ্মীপুর জেলায়।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্মীপুরে এবার সয়াবিনের বাম্পার ফলন হবে। ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে কৃষকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতে কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন।